বাংলা লেখক পরিচিতি

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার কৈশাের ও যৌবনের অধিকাংশ সময় ভাগলপুরের মাতুলালয়ে অতিবাহিত হয়। দারিদ্র্যের কারণে কলেজ শিক্ষা অসমাপ্ত থাকে। জীবিকার সন্ধানে রেঙ্গন গমন ও সেখানে অবস্থানকালে (১৯০৩-১৯১৬) সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়ােগ করেন। ১৯০৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় বড়দিদি’ উপন্যাস প্রকাশিত হলে তার সাহিত্যিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর একের পর এক গল্প-উপন্যাস লিখে তিনি এমনভাবে পাঠক হৃদয় জয় করেন যে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকে পরিণত হন। সাধারণ বাঙালি পাঠকের আবেগকে তিনি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলাের মধ্যে রয়েছে :‘পল্লীসমাজ’, ‘দেবদাস’, শ্রীকান্ত . (চার পর্ব), গৃহদাহ’, ‘দেনাপাওনা’, ‘পথের দাবী’, ‘শেষ প্রশ্ন প্রভৃতি’। সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট উপাধি লাভ করেন। বাংলা সাহিত্যের এই কালজয়ী কথাশিল্পীর জীবনাবসান ঘটে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায়।

কাজী নজরুল ইসলামঃ

কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) বর্ধমান জেলার আসানসােল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করতে পারেন নি। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্কুল ছেড়ে বাঙালি পল্টনে যােগদান করেন। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হয়। নজরুল কলকাতায় ফিরে এসে সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়ােগ করেন। এ সময় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে চারদিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর কবিতায় পরাধীনতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উচ্চারিত হয়েছে। অবিচার ও শােষণের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল প্রতিবাদ করেন। এজন্য তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। তাঁর রচনাবলি ।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কবিতা, সংগীত, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও গল্প-সাহিত্যের সকল শাখায় আমরা তাঁর প্রতিভার উজ্জ্বল পরিচয় পেয়ে থাকি। তিনি সাম্যবাদী চেতনাভিত্তিক কবিতা, শ্যামাসংগীত, ইসলামি গান ও গজল লিখে প্রশংসা | পেয়েছেন। তিনি আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারে কুশলতা দেখিয়েছেন। দুর্ভাগ্য যে, মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে তিনি কঠিন রােগে আক্রান্ত হন এবং তাঁর সাহিত্যসাধনায় ছেদ ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর | ১৯৭২ সালে কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে | ডি.লিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও একুশে পদক পান।

তিনি আমাদের জাতীয় কবি। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলাের মধ্যে রয়েছে, কাব্যগ্রন্থ : ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, | ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘চক্রবাক’; উপন্যাস : মৃত্যুক্ষুধা’, কুহেলিকা’; গল্পগ্রন্থ : ব্যথার | দান’, ‘রিক্তের বেদন’ ‘শিউলিমালা’; প্রবন্ধগ্রন্থ : ‘যুগবাণী’, ‘রুদ্র-মঙ্গল’; নাটক : ‘ঝিলিমিলি’, ‘আলেয়া’, মধুমালা’ ইত্যাদি। কবি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে চব্বিশ পরগনা জেলার মুরারিপুর গ্রামে, মাতুলালয়ে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার ব্যারাকপুর গ্রামে। তাঁর বাল্য ও কৈশােরকাল কেটেছে দারিদ্রের মধ্যে। মাতার নাম মৃণালিনী দেবী। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পেশা ছিল কথকতা ও পৌরােহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়াকালে (১৯১৮) তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু ঘটলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অসমাপ্ত থাকে। অতঃপর স্কুল শিক্ষকতাসহ নানা পেশায় তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়। এর বাইশ বছর পরে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন (১৯৪০)। ছােটগল্প, উপন্যাস, দিনলিপি ও ভ্রমণকাহিনী রচনার মধ্যেই তিনি জীবনের আনন্দ খুঁজে পান। তাঁর রচিত সাহিত্যে প্রকৃতি ও মানবজীবন এক অখণ্ড অবিচ্ছিন্ন সত্তায় সমন্বিত হয়েছে। তার সাহিত্যে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য ও গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনাচরণের সজীব ও নিখুঁত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ উপন্যাস যেমন তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি তেমনি বাংলা সাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ। তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে উল্লেখযােগ্য উপন্যাস : ‘আরণ্যক’, ‘ইছামতী’; গল্পগ্রন্থ : ‘মেঘমল্লার’, ‘মৌরীফুল’; ভ্রমণ-দিনলিপি : ‘তৃণাঙ্কুর’, ‘স্মৃতির রেখা’; কিশাের উপন্যাস : ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘মিসমিদের কবচ’, ‘হীরামানিক জ্বলে’। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ

বাংলা উপন্যাস ও ছােটগল্পের লেখক হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় খ্যাতিমান। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাঁওতাল পরগণার দুমকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালবদিয়া গ্রামে। দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রভৃতি উপন্যাস এবং প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সরীসৃপ’, ‘সমুদ্রের স্বাদ’, ‘টিকটিকি, ‘হলুদ পােড়া’, ‘হারানের নাতজামাই’ প্রভৃতি ছােটগল্পের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। মানুষের মন বিশ্লেষণের দিকেই ছিল তার ঝোঁক। তিনি শ্রমিক-কৃষকের কল্যাণের কথাও ভেবেছেন। শােষণ থেকে তাদের মুক্তির জয়গান গেয়েছেন গল্প-উপন্যাসে। তিনি মাঝির ছেলে’ নামে একটি কিশাের-উপন্যাস রচনা করেন। তার কিশাের-উপযােগী গল্পের সংখ্যা ২৭। এর মধ্যে কোথায় গেল? জব্দ করার প্রতিযােগিতা’, ‘তিনটি সাহসী ভীরুর গল্প’, ‘ভয় দেখানাের গল্প’, ‘সনাতনী’, দাড়ির গল্প’, ‘সূর্যবাবুর ভিটামিন সমস্যা প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল দারিদ্র্য। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের পুরােধা ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাদের জাতির পিতা। তাঁর জন্ম ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ গােপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মাতার নাম সায়েরা খাতুন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতি ও দেশব্রতে যুক্ত হন। ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যােগ দিয়ে তিনি বহুবার কারাবরণ করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনায় তার অবদান অপরিসীম। তিনি বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি ৬ দফা আন্দোলনের মুখ্য প্রবক্তা। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের | সূচনাকালে ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। 

১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পরে পাকিস্তানি বাহিনী | বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতাকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার মহান দায়িত্বে ব্রতী হন। তাঁর সরকারই স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করে (১৯৭২)। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের | অধিবেশনে তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বাংলাকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।

 

 

 

 

 

Source: NCTB Text Book